bengali, fiction

তেহাই

ভরত, রাখাল চন্দ্র প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস ফাইভে পড়ে। এখন গরমের ছুটি হলেও, মায়ের ভয়ে সন্ধ্যে বেলায় উঠোনে লন্ঠন জ্বালিয়ে পড়তে বসতে হচ্ছে। আজ সন্ধ্যেবেলায় সে চিত্তোরগড় দুর্গের কথা পড়ছিল। পড়তে পড়তেই তার চোখের সামনে বাগানপাড়ার মসজিদের সোনালি দরজাটা ভেসে উঠল। চিত্তোরগড় দুর্গের দরজাটাও নিশ্চই ওই রকমই দেখতে হবে। এবার বাবা বহরমপুর থেকে ফিরলে, চিত্তোর গড়ে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলতে হবে।
ঢুলতে ঢুলতে পড়া শেষ করে ভরত তার দাদুর সঙ্গেই রাতের খাওয়া সেরে নিল। এরপর সে তার দাদুর সঙ্গে গোবিন্দ সাগরের ওপারের দুগ্গা মন্ডপে হরিসভায় যাবে। ভরতের দাদু ওখানে কীর্তন গাইবেন আর ভরত তাঁর সঙ্গে খঞ্জনি বাজাবে। তবে তার আসল লোভ দাদুর বন্ধু ফজলু দাদুর খোল বাজনা শোনা।
ফজলু দাদু রোগা আর ধ্যাঙা, গোটা মাথায় সাদা চুল ঘাড় অব্দি ঝুলে আছে। দাদু যেখানেই কীর্তন গাইতে যায়, ফজলু দাদুকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তিনি যখন শ্রীখোলটা গলায় ঝুলিয়ে আলতো করে বায়াতে তর্জনী ঠেকান, ‘তুং’ করে খোলটা বেজে ওঠে। তারপর সেই ‘তুং’ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চারদিকে উড়ে যায়। ভরতের কান সেই গুঁড়ো গুলোকে খুঁজে বেড়ায়।
ফজলু দাদু ভারতকে কথা দিয়েছে, তাকে এবার খোল বাজানো শিখিয়ে দেবে। সেও তখন দু হাত দিয়ে বোল তুলবে-
“খিক কি নি গ ধা, থা ঘী থা থা, থা ঘী থা থা ধেই,
থিক টা টা, থেতে থেতে তা…”
নৈলে ফজলু দাদু মরে গেলে, তার দাদুর সঙ্গে খোল বাজাবে কে?
আজ হরিসভা ভাঙতে বেশ দেরি হল। ফজলুল মিঞা তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা হাতে আছে। বাড়ি ফিরে একটু ঘুমিয়ে নেবে। তারপরইতো আবার উঠে, ফজরের নামাজ পড়ে, সাহারি সারতে হবে। সামনের জুমুয়াবারে বাগানপাড়া মসজিদে এই বছরের রমজান মাসের শেষ জুম্মা সালাত হবে। এই সালাতে খুতবার জন্যে নিজেকে খাতিব করার জন্যে ইমামের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। আগে অনেকবার বলেও কোন সুবিধে হয়নি, এবার আরও ভাল করে দরখাস্ত করতে হবে।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফজলুল মিঞা কখন যে গোবিন্দ সাগরের পারে, বেল গাছ গুলোর তলায় পৌঁছে গেছিল খেয়াল ছিল না। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল নিজের সামনে বেলগাছের ব্রহ্মদত্যিকে দেখে। আজ সে কমলা রঙের পাঞ্জাবি পড়ে সাদা টাট্টু ঘোড়ায় চেপে এসেছে। ব্রহ্মদত্যিকে দেখে ফজলুল মিঞা হাত জোড় করল।
– পেন্নাম হৈ গো কত্তা।
ব্রহ্মদত্যি হাত তুলে আশীর্বাদ করে। তারপর ব্যঙ্গ করে বলেন, “ছো ছো ফজলি, তুই কি যে করছিস? সন্ধ্যে বেলায় হরিনাম আর সকাল বেলায় ফজরের আযান পড়ছিস। তোর ইন্তেকালের পর তোর রুহ কে যে আলমে বরযখে রাখা যাবে না। আর কেয়ামতের দিন আল্লাহ তালা তোকে নিশ্চই জাহান্নামের আগুনে পোড়াবে। দেখে নিস।”
ফজলুল মিঞা হেসে ফেলে। তারপর জিভ কেটে, কান ধরে উত্তর দেয়, “কি যে বলেন কত্তা!! আপনারা হলেন গিয়ে আল্লাহ তালার তৈরি জিন। আপনারা থাকতে এই দুনিয়ায় কেয়ামত আসবে কি করে? আর আমার এই হরিনাম আর পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ আসলে আজীবন পাপের জন্যে ক্ষমা চাওয়া। জোয়ান বয়েসে পেটের দায়ে জ্যান্ত পাঁঠা কেটে বেচেছি। তাদের গলার মিহি ম্যা ম্যা মনে কষ্ট দিলেও, জানে পাথর রেখে তাদের হালাল করেছি। জানেন কত্তা, যারা সেই মাংস খেয়েছে, তাদের কোন পাপ হয়নি, সব পাপ আমার ভাগে এসেছে। তাই রুহ বেরোনোর আগে সেই পাপ গুলোকে ধুয়ে নিতে চাইছি। আর আপনিও জানেন কত্তা, যে হরি, সেই আল্লাহ। শুধু তাদেরকে পাওয়ার রাস্তাই যা একটু আলাদা। আমি দুই রাস্তাতেই তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি কত্তা। এই আর কি!”
ব্রহ্মদত্যি মুচকি হাসেন। “বুঝেছি রে ফজলি। তবে আজ কিন্তু তোরই দিন। ওই দেখ। ওই দিকে চেয়ে দেখ, তোর জন্য ফেরেশতারা ইত্ৰ আর কফিন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
তারপর তিনি সেই কথাটা উচ্চারণ করলেন, যার জন্য ফজলুল মিঞা এতদিন অপেক্ষা করছিল, “ইয়া আইয়ুহাতুর রুহ, মুতমা ইন্না।”
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে সবাই দেখল ফজলুল মিঞা গোবিন্দ সাগরের পারে বেলগাছটার তলায় শুয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে। কি শান্তিতেই না ঘুমিয়ে আছে। ছোট্ট গঞ্জ শহরে খবর ছড়াতে দেরি হল না। অনেকগুলো চোখের জলে ভেজা মাটিতে তাঁর মৃতদেহ কবর দেওয়া হল।
ভরতেরও খুব মনখারাপ হল। তার ফজলু দাদু যে তাকে তেহাই না শিখিয়েই চলে গেল।

Leave a comment