bengali, fiction

রং চটা টিনের কৌটো আর একটা চিঠি

চয়নের বদলির চাকরী। প্রায়ই তাকে লোটা কম্বল নিয়ে এক জায়গা থেকে উড়ে গিয়ে আরেক জায়গায় নতুন করে ঠাঁই গড়তে হয়। তবে এবারে পোস্টিং তিলোত্তমায়।

Two men

যদিও চয়নের আসবাবপত্র বেশি নেই, তবুও গুছিয়ে উঠতে একটু সময় লাগল। কারন ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছিল টেলিভিশন মাথার ঘিলু পচিয়ে দেয়, তাই টিভি না দেখে বই পড়াই উচিৎ। সেই কথাটা আজও চয়ন মেনে চলছে। ঠাঁই বদলের সময় আনত জিনিষগুলোর বেশীর ভাগটাই ওর কেনা বইপত্রে ভর্তি। প্যাকার্স আর মুভার্সদের লোকজনেরাই চয়নের এই এক কামরার ভাড়া ফ্ল্যাটে সব কিছু গুছিয়ে দিতে সাহায্য করেছে।

একেক দিন বেশি পরিশ্রম করলে রাত্রে ঘুম আসে না। আজ চয়নেরও বেশ ধকল গেছে, তাই তার ঘুম আসছে না। একটা বই পড়লে হয়ত লাভ হবে, এই ভেবেই সে বইয়ের আলমারির পাল্লাটা খুলল। আজ সন্ধ্যাবেলায় সে নিজের হাতে বইগুলো সাজিয়েছিল, তবু কি পড়বে ভাবতে ভাবতেই সে বইগুলোর দিকে একবার নজর বুলিয়ে নিচ্ছিল। তলার দিকের তাকে হঠাৎ একটা রং চটা টিনের কৌট দেখে অবাক হল। এই কৌটাটা কোত্থেকে এল? এটাকে এখানে কে রেখেছে? ওই মুভার্স এন্ড প্যাকার্সদের লোকগুলো কি ভুল করে রেখেছে? সে কৌটটাকে হাতে করে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসল।

কিছুক্ষন ওই টিনের কৌটটার দিকে তাকিয়ে থেকে, চয়ন কৌটোর ঢাকনাটা খুলে সেটাকে চোখের সামনে এনে ধরল। ভেতরে দুটো পুরোন বাসের টিকিট আর একটা চিঠি রাখা আছে। দুটো আঙ্গুল দিয়ে আগে সে বাসের টিকিট গুলোকে বের করে দেখল। ভাড়া ১.৭৫ পয়সা। চয়ন হেসে ফেলল। এই ভাড়া! মানে সে অনেক যুগ আগের কথা। এবার কৌটোর ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে, সে কৌটাটা সামনে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। চিঠিটা খুলল।

হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার ওপর সরু নীল লাইনের মাঝে সবুজ কালি দিয়ে লেখা একটা চিঠি। চয়ন পড়তে শুরু করল–

আমার নীরা,
আজ মন ভাল নেই। চাকরীর পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি পাশ করতে পারিনি। এই চাকরীটাও পেলাম না। তবে একটা চাকরী আমি জোগাড় করবই। আমায় করতেই হবে। আমি যে এখনও স্বপ্ন দেখি, তোমায় নিয়ে ঘর বাঁধার। তোমার আমার একটা ছোট্ট সংসার। যেখানে আমি নিজের হাতে মাছের ঝোল রেঁধে তোমায় খাওয়াবো। ঝাল লেগে তোমার চোখে জল এলে, আমি সেটা মুছে দিয়ে হাসব। বলব, এত বড় হয়ে গেলে, এখনও ঝাল খেতে পারো না! তুমি কিন্তু একটু অপেক্ষা করো। সামনের মাসে আবার কলকাতা যাব, আরেকটা পরীক্ষা দিতে। তখন আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে। আজ আসি।
তোমারই,
আমি।

চয়ন চিঠিটা বার কয়েক পড়ল। তার চোখের সামনে সময়ের পর্দা সরে গিয়ে ভেসে উঠছে একটা লম্বা হল ঘর। লাল মোজাইক করা মেঝে, তার ওপর পূবের জানলা দিয়ে ঢুকে পরা চাঁদের আলো আর গ্রিলের বাহারি নকশার ছায়া ছড়িয়ে আছে। হল ঘরটার শেষের দিকে একটা মশারী টাঙানো খাট, আর তার ঠিক গায়ে লাগানো একটা বড় টেবিল। একটা নীল রঙের টিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, আর সেই আলোয় ঘরের একটু অন্ধকার কাটছে। টেবিলের ওপর অনেক বই খাতা রাখা আছে। একটা ছেলে সেখানে মাথা গুঁজে কিছু লিখে চলেছে। চাঁদের আলো এসে সেই ছেলেটার মাথার কাছে থেমে গেছে।

হঠাৎ চয়নের খেয়াল হল, সে কি স্বপ্ন দেখছে? নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটল। উফঃ। নাঃ, এটা একদম বাস্তব। কিন্তু কি ভাবে সম্ভব? চয়ন যখন এই সব কথা ভাবছে, তখন চেয়ার থেকে সেই ছেলেটা উঠে এগিয়ে এল। নাহ, সে চয়নকে দেখতে পায়নি। চয়নের পাশ দিয়েই হেঁটে গিয়ে, সে একটা কাঠের দরজা খুলল। সামনে একটা ছাত। সেখানেও জ্যোৎস্না থৈ থৈ করছে। ছেলেটা ছাদে এসে দাঁড়াল। চয়ন তার পেছনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটা ওকে ভ্রুক্ষেপ না করেই, কিছুক্ষন মাথা তুলে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর দরজার কাছে ফিরে গিয়ে, সেটার পাল্লায় ঝুলে থাকা লোহার কড়া দুটোকে টেনে দরজাটা ঠেকিয়ে দিল। তারপর ছাদের এক কোণায় জমে থাকা আবর্জনার ঢিপি থেকে একটা ছোট্ট টিনের কৌট কুড়িয়ে নিয়ে, তার ঢাকনা খুলে, পকেট থেকে একটা চিঠি তার মধ্যে ভরে, ঢাকনাটা লাগিয়ে দিল। তারপর সেটা হাতে ধরেই ছেলেটা ছাদের কার্ণিশের ওপর উঠে দাঁড়াল। সামনে রেলস্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে। স্টেশনের মাইকে দূরপাল্লার কোন ট্রেন আসার ঘোষণাও হাওয়ায় আবছা ভেসে আসছে। রেলস্টেশনের ওপারে ওয়্যারলেস টাওয়ারের মাথায় একটা লাল আলো জ্বলে উঠছে, নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলে উঠছে…

ছেলেটা কার্ণিশের ওপর দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন সেই ওয়্যারলেস টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে, হাতের কৌটোটা ওয়্যারলেস টাওয়ারের দিকে ছুঁড়ে দিল। কৌটাটা কিছুক্ষন চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠেই রাতের কালো আকাশে মিলিয়ে গেল। চয়ন জানে, এবার ছেলেটা কি করবে। তাকে সেটা করতে দেওয়া যাবে না। চয়ন এক লাফে কার্ণিশের কাছে এগিয়ে গিয়ে, ছেলেটার পা চেপে ধরল। ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকাল, তারপর কিছু বুঝতে না পেরে, চিৎকার করে উঠল– আ আ আ……

ছেলেটা কার্নিশ থেকে নেমে, ছাদ পেরিয়ে হল ঘরটায় ফিরে এসে, টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়ল। চয়ন ছেলেটার পেছন পেছন টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। ছেলেটার চোখ টেবিলের ওপর রাখা একটা খোলা খামের দিকে স্থির হয়ে আছে। ওপরে ডান দিকের কোণায় খয়েরী রঙের অশোক স্তম্ভ ছাপা হলুদ খাম। পোস্ট অপিসের কালো গোল পোস্টমার্ক তার কিছুটা অংশ লুকিয়ে রেখেছে। এই খামের ভেতরেই এক তোড়া চিঠি ভাঁজ করে রাখা আছে। চয়ন জানে সেই চিঠিতে কি লেখা আছে। খামের ওপর লেখা ঠিকানার প্রথম লাইনেই যে তার নাম লেখা আছে – চয়ন মিত্র।

কুড়ি বছর আগের চয়ন কে না বাঁচালে কি করে সেদিন রাতের আকাশে হারিয়ে যাওয়া রং চটা টিনের কৌটোটা সে আজ খুঁজে পেত? তাছাড়া তার নীরাকে দেওয়া, নিজের হাতে মাছের ঝোল রেঁধে খাওয়ানোর কথা রাখাটাও বাকি আছে যে।

ছবি সৌজন্য: সামান্থা অগাস্টিন (জার্মানি)

Leave a comment