bengali, fiction

টাইম কীপার

ক্রমবর্ধমান মধ্যবয়সী মধ্যপ্রদেশের তাড়নায় এবং নিজেদের স্বাস্থ্য তরিবতের জন্য আমরা প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমনের একটি নিয়মিত পন্থা মেনে চলি। আমরা বলতে, বিশ্ব-বাংলা সরনী সংলগ্ন আমাদের এই রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের জনা সাতেক বঙ্গজ। যদিও আমাদের এই রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের বেশিরভাগ বাসিন্দাই অবাঙালী, কিন্তু তাদের মধ্যেও যে কজন বাঙালি টিকে আছি, বেশিরভাগই নিজেদের উত্তর কলকাতার বসত বাড়ি বিক্রি করে এখানে ঘাঁটি গেড়েছি। সেখানকার খোলা উঠোন ছেড়ে, পায়রার খোপে জায়গা নিয়ে আমাদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগটাও কমে গেছে। তবে যে কজন এখনও আমাদের পূর্বজন্মের স্মৃতি পুরোপুরিভাবে মুছে ফেলতে পারিনি, তারাই এই প্রাতঃভ্রমনের বিলাসিতার পর আমাদের কমপ্লেক্সের বাইরে গিয়ে, উল্টো ফুটে নাকুর দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিই।

নাকুর চায়ের দোকানটা অবশ্য আমাদের রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু বাইপাসের ওপর যে সব ট্যাক্সি আর অ্যাপক্যাব গুলো চলে, তাদের ড্রাইভারদের দৌলতেই এই দোকানটা টিকে আছে। তবে প্রত্যেকদিন যেহেতু নাকুর দোকানের প্রথম খদ্দের আমরাই হই, তাই আমাদের নাকু খাতিরটাও বেশ ভালই করে।

তবে আজকে আমাদের তিন পাক শেষ করে নাকুর দোকানে পৌঁছে দেখি রোজকার রুটিন পাল্টে গেছে। মানে, আমাদের পৌছনোর আগেই নাকুর দোকানে এক নতুন খদ্দের এসে বসে আছে। আধময়লা আলখাল্লা পরা এক বুড়ো, নাকুর দোকানের সামনে ফুটপাথের ওপর পাতা কাঠের বেঞ্চটায় বসে নিজের বাঁ হাতে চায়ের গেলাসটা ধরে, তাতে ডান হাতে ধরা একটা বেকারি বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। ওই বুড়োকে বসে থাকতে দেখে আমাদের পছন্দ হল না। একটু ব্যঙ্গ করে বলেই ফেললাম, ‘কি রে নাকু!? আজ দেখছি সকাল থেকেই তোর বাজার বেশ ভালই জমেছে!’
উত্তরে নাকু ঘাড় হেলিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে, সেই বুড়োর উদ্দেশ্যে বলল, ‘কাকা একটু সরে বসো, এই বাবুরাও বসবে।’ নাকুর কথায় বুড়োটা একটু নড়েচড়ে বসল বটে, কিন্তু তাতে জায়গা যে বাড়ল, তা নয়।

আমাদের দলের বিলাস একটু বিরক্ত হয়েই বেঞ্চের অপর প্রান্তে বসল। তারপর আড় চোখে বুড়োটাকে দেখে বলল, ‘আজকাল কত খবর বেরোচ্ছে, ভিন রাজ্য থেকে লোক এসে এখানে কত সব ষড়যন্ত্র আর অপরাধ ঘটাচ্ছে। পেপারে – টিভিতে, সর্বত্র বলছে এলাকায় বাইরের অচেনা লোক দেখলেই পুলিশে খবর দিতে।’ তারপর নাকুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুই বাবা চোখ কান খোলা রাখিস। নে এখন আমাদের চা গুলো দে।’

নাকুর দেওয়া চায়ের গেলাসে সবে একটা চুমুক দিয়েছি, হঠাৎ বুড়োটা আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলে উঠল, ‘বিখতে লি মি ৎসিগারা!?’
বলার ধরণে বুঝতে অসুবিধে হোল না যে বুড়ো কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে, কিন্তু এ কি বিটকেল ভাষা? উত্তরে আমার মুখ দিয়ে শুধু ‘ইঞা’ ছাড়া আর কোন শব্দ বেরোলো না। বুড়োটা ততক্ষনে বোধহয় আমার অসুবিধেটা বুঝতে পারল। তাই লজ্জায় জীভ কেটে, পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘ইস, ভুল করে বুলগেরিয়ান ভাষার বোতামটা টিপে ফেলেছিলাম। বুঝতেই পারছ, বয়েস হয়েছে। যাই হোক, আমায় একটা বিড়ি দিতে পারবে?’
বুড়োর কথায় বিরক্তই হলাম। চেনা নেই, জানা নেই, দুম করে বিড়ি চাইছে? আবার বিদেশী ভাষা শুনিয়ে ইমপ্রেস করতেও চাইছে? এ বুড়ো দেখছি পাক্কা শেয়ানা মাল। কয়েক সেকেন্ড থেমে থাকার পর বিলাস বেশ গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, ‘ইয়ার্কি করছেন? কোথায় থাকেন? এখানে কেন এসেছেন?’
বুড়োর মধ্যে কোন হেলদোল হোল না। সে একটু হেসে বলল, ‘ওহে বিলাস উত্তেজিত হোস নে। গত মাসে একটা স্ট্রোক সামলে নিয়েছিস ঠিকই, কিন্তু আজকাল তোর ব্লাড প্রেশার উপর দিকেই আছে। বেশি উত্তেজিত হলে আবার তোর শরীর খারাপ করবে।’
এবার বিলাসের সঙ্গে আমাদেরও কথা বন্ধ হয়ে গেছে। এ বুড়ো বিলাস কে তুই তোকারি করছে। আবার বিলাসের স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও জানে। একে তো আর হালকা ভাবে নেওয়া যায় না।

আমাদের চায়ের গেলাস গুলো হাতেই ধরা রয়েছে, কিন্তু আমাদের সাত জোড়া চোখ ওই বুড়োর দিকে স্থির হয়ে গেছে। সবার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরঘুর করছে, এ কে? নাকু আমাদের অবস্থা দেখে বোধহয় বেশ মজাই পাচ্ছে। সে আমাদের ওই স্থানুবর অবস্থায় দেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বুড়োকে একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। বুড়ো সেই বিড়িটা নিজের দাঁতের ফাঁকে চিপে ধরে, সেটার ডগার সামনে, নিজের ডান হাত দিয়ে একটা চুটকি বাজালো আর একটা জোরে টান দিয়ে এক প্রস্থ ধোঁয়া ছেড়ে দিল। আমরা যেন একটা ম্যাজিক দেখছি, এমন ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে গোটা ঘটনাটা দেখলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমাদের মর্নিংওয়াক করে যতটা ঘাম হয় তার কয়েকগুন বেশি ঘাম এখন আমাদের সবার শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে।

আমাদের অবস্থা দেখে বুড়ো এবার আস্বস্ত করার চেষ্টা করল, ‘তোরা দেখছি বেশ ঘাবড়ে গেছিস। অবশ্য এমন হবে আমার বোঝা উচিৎ ছিল। নাঃ, তোদের কে আমার পরিচয়টা দিতেই হচ্ছে, তাহলে যদি একটু শান্ত হোস।’
এই বলে তিনি নাকুর দিকে ইশারা করে কাছে ডাকলেন। নাকুও ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। বুড়ো আবার বলতে শুরু করল, ‘এবার একটু মন দিয়ে শোন, তোদের বোঝার মত করেই বলি। এই নাকু হচ্ছে আমার এজেন্ট। এর মত কয়েক কোটি এজেন্ট এখানে, মানে এই পৃথিবীর, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আর আমি হচ্ছি ইন্টারগ্যালেকটিক টাইম কীপার। তোদের এখানে যা কিছু হয়, সবকিছুর রেকর্ড আমি, মানে আমার মত টাইম কীপাররা রাখে। অবশ্য তোরা আমাদের চিত্রগুপ্ত বলে ডাকিস।’ এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে বুড়ো একটু থামল, তারপর নিজের হাতে ধরা বিড়িতে আরেকটা টান দিয়ে, আবার বলতে শুরু করল
‘এই পৃথিবী তো আসলে আমাদের মনিবদের খেলার জায়গা। ওনারা এখানে এসে তোদের তৈরি করে দিয়ে ফিরে গেলেন। তারপর আড়াল থেকেই তোদের কাজ কর্ম দেখে নিজেদের সময় কাটাচ্ছেন আর মজা লুটছেন। কিন্তু যেই তোরা নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে এই পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাস, তখন আমাদেরকে এখানে পাঠিয়ে তোদের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে সময়ের গতিকে ঠিক করিয়ে নেন, যাতে তোদের খেলা আবার শুরু হয়, আর ওনাদের মনোরঞ্জনও চলতে থাকে।’

আমরা কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমাদের মাথায় তখন ওঁর বলা কথা গুলো সত্যি না মিথ্যে, তা নিয়ে দোলাচল শুরু হয়ে গেছে। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই বুড়োর কথা শুনব না নিজের নিজের আস্তানায় ফিরে গিয়ে, অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হবো, সে চিন্তাও আসছে। কিন্তু আমাদের পা যেন মাথার কথা শুনতে চাইছে না।

আমাদের এই চিন্তাগুলোও বোধহয় বুড়োটা বুঝতে পারল। সে তখন মিটিমিটি হাসছে। একবার মনে হল, এটা নিশ্চই আমার স্বপ্ন। নিজেকে চিমটি কাটতে গিয়ে বুঝলাম আমার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। এবার বুড়োটা সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি হে সরোজ, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? হবেই বা কি করে, তোরা যে বিশ্বাস জিনিসটাকেই নষ্ট করে ফেলেছিস। সব কিছুতেই প্রমাণ চাস, অথচ তোদের জানার সীমানাকে প্রশস্ত করতে চাস না।’
আমি একবার ঢোক গিলে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু গলা দিয়ে খসখস করে একটা আওয়াজ ছাড়া কিছুই বেরোলো না। বুড়ো আমার দিকে চোখ টিপে আবার বলতে শুরু করল, ‘তোদের অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। আসলে তোদের এই গ্রহে বেঁচে থাকার জন্যে কিছু কিছু ক্ষমতা দিতেই হয়েছিল। নইলে তোদের সারভাইভাল হোতো না। কিন্তু তোরা সেই ক্ষমতার জোরে নিজেদের কে সর্বশক্তিমান ভেবে ফেলেছিস। আর সেখানেই বিপত্তি। যেই ক্ষমতা গুলোকে কে চিনে নিতে পারছিস, ভাবছিস এতো আমার ক্ষমতা। আর তারপর নিজেদের চেনা ক্ষমতা গুলোর আস্ফালন করতে গিয়ে যুগে যুগে নিজেদের মধ্যেই সম্পর্কগুলোকে গুলিয়ে ফেলে বারবার এই পৃথিবীটাকে ধংসের মুখে নিয়ে গিয়ে দাঁড় কড়াচ্ছিস। আর আমাকেও তাই বারবার ফিরে এসে সব কিছু ঠিক করে দিয়ে যেতে হচ্ছে।’

বুড়ো একটু থামল। তারপর নাকুর দিকে হাত নাড়িয়ে কিছু একটা ইশারা করে, আবার আমাদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘নাহ, এবার কাজে নামতে হবে। এক্ষুনি সিরিয়া যেতে হবে। তবে হ্যাঁ বাবুরা, তোরা যে আমায় দেখেছিস, এ কথা কাউকে বলিস না। কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে একটু ভেবে কাজকম্মো গুলো করিস, তাহলে এই বুড়ো বয়েসে বারবার আমায় ডায়মেনশন পেরিয়ে আসতে হয় না।’

OSCAR ALVAREZ, Spain

এরপর যেটা হল, সেটা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। তবু বলি, আমাদের চোখের সামনে নাকু একটা কালো আরবি ঘোড়া হয়ে গেল আর ওই বুড়ো সেটায় চেপে বসতেই ঘোড়াটা হাওয়ার মধ্যে একটা গর্ত তৈরি করে সেঁধিয়ে গেল। কি? কথা গুলো বিশ্বাস হল না তো? গোটাটাই গাঁজাখুরি বলে মনে হল!? দিব্যি খেয়ে বলছি, আমি কিন্তু আজ তিন পেগের বেশি খাইনি। তবে এই খবরটাও কিন্তু একদম সত্যি– ‘গভীর রাতে আচমকাই সিরিয়ায় ভয়াবহ মিসাইল হামলা চালায় ইজরায়েল। নিশানা করা হয় ইরানের সেনা ঘাঁটি, জ্বালানির গুদাম ও অস্ত্রাগারগুলিকে। এছাড়াও দামাস্কাসেও আছড়ে পড়েছে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সে-এর মিসাইল। ইজরায়েলের সেনাবাহিনী সূত্রে খবর, হামলা সফল।’

ছবি সৌজন্যঃ অস্কার আল্ভারেজ (স্পেন)

2 thoughts on “টাইম কীপার”

    1. ধন্যবাদ। আমাদের চারদিকে যা কিছু ঘটছে বা ঘটে চলেছে, সেটা কতটা সঙ্গত, এটাই আমার প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেড়িয়েছি।

      Like

Leave a comment